সেন্টমার্টিন (Saint Martin)
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের মূলভূখন্ডের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন (Saint Martins Island)। স্থানীয় ভাষায় সেন্টমার্টিনকে নারিকেল জিঞ্জিরা বলেও ডাকা হয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত এ দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। অসীম নীল আকাশের সাথে সমুদ্রের নীল জলের মিতালী, সারি সারি নারিকেল গাছ এ দ্বীপকে করেছে অনন্য, যা ভ্রমণ পিয়াসী মানুষকে দুর্নিবার আকর্ষনে কাছে টেনে নেয়।
সেন্টমার্টিন যাওয়ার উপায়
সেন্টমার্টিন যাবার বেশিরভাগ শীপ টেকনাফ থেকে ছেড়ে যায়। তাই সেন্টমার্টিন যেতে চাইলে কক্সবাজার জেলা টেকনাফ চলে যাওয়া সুবিধাজনক। টেকনাফ থেকে জাহাজে অথবা ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে যেতে চাইলে সরাসরি বাসে টেকনাফ গিয়ে সেখান থেকে জাহাজে/ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন যাওয়া সুবিধাজনক। কক্সবাজার ভ্রমণ পরিকল্পনায় থাকলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার হয়ে তারপর টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন। অথবা কক্সবাজার থেকে এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস শীপে সরাসরি সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকেও সেন্টমার্টিন যাবার এমভি বে ওয়ান শীপ চালু হয়েছে। সেন্টমার্টিন যাওয়ার সাম্ভাব্য সকল উপায় নিচে বিস্তারিত দেওয়া হলো।
ঢাকা থেকে টেকনাফ যাবার উপায়
ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি টেকনাফে যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী, কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ ও আবদুল্লাহপুর থেকে শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, সেন্টমার্টিন হুন্দাই, রয়েল কোচ, তুবা লাইন, এস আলম, মডার্ন লাইন, গ্রীন লাইন ইত্যাদি বাস সরাসরি টেকনাফ যায়। ভাড়া সাধারণত বাস ও ক্লাস অনুযায়ী ১০৫০ থেকে ২২০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। যদি শুধু সেন্টমার্টিন যেতে চান তাহলে ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে টেকনাফ চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। রাত ৮-১০ টার মধ্যে বাস রওনা দিয়ে সকাল ৮টার মধ্যে টেকনাফ পৌঁছে যায়।
কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ যাবার উপায়
ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজার এসে তারপর কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে প্রতিদিনই গ্রীন লাইন, সোহাগ, টিআর ট্রাভেলস, শ্যামলী, হানিফ, সৌদিয়া, ঈগল, এস আলম, সিল্ক লাইন, সেন্টমার্টিন ইত্যাদি অনেক বাস কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বাস ভেদে ভাড়া সাধারণত ৯০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও ঢাকা থেকে বিমানে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া যায়।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ :
কক্সবাজার থেকে লোকাল বাস/মাইক্রো/জিপ/সিএনজি ভাড়া করে টেকনাফ যাওয়া যায়। কক্সবাজার হতে টেকনাফ যাওয়ার বাস ভাড়া ১৫০ টাকা ও সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। টেকনাফ যেতে অবস্থা ভেদে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। আর সকালের জাহাজ ধরতে চাইলে কক্সবাজার থেকে ভোরে (৬টার মধ্যে) টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ যাবার উপায় :
চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস থেকে এস আলম এবং সৌদিয়া বাস রাত ১২ টায় টেকনাফের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া জিএসই গরিবুল্লাশাহ মাজার ও দামপাড়া থেকেও কিছু বাস চট্টগ্রাম-টেকনাফ রুটে চলাচল করে। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ বাসে যেতে খরচ হবে ৫৫০-১২০০ টাকা।
টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাবার উপায় :
সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি জাহাজ/শীপ আসা যাওয়া করে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী শীপের মধ্যে আছে কেয়ারী সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রজ এন্ড ডাইন, এম ভি বারো আওলিয়া ,আটলান্টিক ইত্যাদ। জাহাজে করে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘন্টা।
জাহাজের ক্লাস ও মান অনুযায়ী সেন্টমার্টিন যাওয়া ও আসার টিকেট ভাড়া ৮৫০ থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। টেকনাফ জেটি ঘাট থেকে প্রতিদিন জাহাজগুলো সকাল ৯.০০-৯.৩০ মিনিটে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সেন্টমার্টিন থেকে ফেরত আসে বিকাল ৩.০০-৩.৩০ মিনিটে। সেন্টমার্টিন যাওয়ার শীপের টিকেট সাধাণত যাওয়া ও আসা সহ হয়ে থাকে। টিকেট করার সময় কবে ফিরবেন তা উল্লেখ করতে হবে।
কি করবেন ও কি দেখবেন
যারা দিনে গিয়ে দিনেই সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে আসবেন তারা পরবর্তীতে আফসোস করতে পারেন তাই সবচেয়ে ভালো হয় অন্তত একদিন সেন্টমার্টিনে অবস্থান দূরা। এতে যেমন পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে পারবেন তেমনি এই আনন্দময় ভ্রমণ আপনাকে সবসময় মোহিত করবে।
ডে লং ট্রিপ:
যারা সময়ের অভাবে ডে লং ট্রিপে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যাবেন তারা জাহাজ থেকে নেমে সময় নষ্ট না করে ভ্যান নিয়ে সরাসরি চলে আসুন পশ্চিম বীচ বা মেইন বীচে। এর জন্য আপনাকে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা ভ্যান ভাড়া গুণতে হবে। এখানে হেঁটে আসতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগে তবুও ডে লং ট্রিপে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। এই জায়গাটা পানিতে নামার জন্য ভালো তাই বীচে এসে চাইলে সচ্ছ পানিতে গা ভেজাতে পারেন। যাই করেন না কেন অবশ্যই মাথায় রাখবেন আপনাকে ২ টার আগে ফ্রি হতে হবে নইলে খাওয়ার সময়টুকুও পাবেন না। আর অবশ্যই ৩ টার আগেই আপনাকে জাহাজে পৌঁছাতে হবে। হাতে সময় থাকলে মেইন বীচের কাছে হুমায়ূন আহমেদের কটেজ দেখে আসতে পারেন। সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এই ধরণের ট্রিপ আপনাকে সময়ের প্রতি সীমাবদ্ধ করে রাখবে তাই অন্তত এক দিনের প্ল্যান নিয়ে সেন্টমার্টিন আসুন।
১ রাত ২ দিনের প্ল্যান:
যারা এক দিনের প্ল্যান নিয়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসবেন তারা জাহাজ থেকে নেমে হোটেলে উঠে পড়ুন। দুপুরের খাবার খেয়ে হালকা বিশ্রাম নিয়ে চলে আসতে পারেন ছেঁড়া দ্বীপ। চেষ্টা করবেন ৪ টার আগে আগেই রওনা দিতে তাহলে ছেঁড়া দ্বীপে সূর্যাস্ত দেখে ফিরতে পারবেন। ছেঁড়া দ্বীপের সূর্যাস্ত অসাধারণ তবে সূর্যাস্তের পরে বেশি দেরি করবেন না। সন্ধ্যায় মূল দ্বীপে ফিরে বাজারের জেটিতে আড্ডা দিতে পারেন কিংবা পশ্চিম বীচের যে কোন জায়গায় বসাতে পারেন গানের আসর। রাতে বার-বি-কিউ করার ক্ষেত্রে রিসোর্টে করতে পারেন। রিসোর্টে মাছের দাম একটু বেশি নিলেও মাছগুলো ফ্রেশ থাকে। অথবা আশেপাশের হোটেলে পছন্দমত মাছ বারবিকিউ করে খেতে পারবেন। পরদিন সকালের সময়টা চারপাশে হেঁটে কাটিয়ে দিন অথবা আগের দিন ছেঁডা দ্বীপে না গিয়ে থাকলে সকাল সকাল ছেঁড়া দ্বীপ থেকে ঘুরে আসুন। দুপুরের আগেই ফিরে আসুন, গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে আস্তে ধীরে ২ টা ৩০ এর মধ্যে নির্ধারিত জাহাজে উঠে পড়ুন।
সেন্টমার্টিনে কি খাবেন
সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জিনিস হল ডাব যা একাধারে মিষ্টি ও সুস্বাদু। সেন্টমার্টিনে গেলে অন্তত একটা ডাব টেস্ট করা উচিত। যারা মাছ খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য সেন্টমার্টিন কোরাল, সুন্দরী পোয়া, ইলিশ, রূপচাঁদা, লবস্টার, কালাচাঁদা ইত্যাদি নানান ধরনের ও স্বাদের বাহার নিয়ে অপেক্ষা করছে। নিজের মত করে মাছ পছন্দ করে কিনে বারবিকিউ করার সুযোেগ থাকে সব রিসোের্ট ও হোটেলেই। আর যদি সুযোগ হয় তবে কুরা খেয়ে দেখতে পারেন (দেশী মুরগিকে কুরা বলে ডাকা হয়)। এখানে আরো রয়েছে অফুরন্ত লইট্টা, ছুড়ি, রূপচাঁদা, কাচকি ইত্যাদি জানাঅজানা শুটকি মাছের ভান্ডার। এছাড়া গরমের সময় গেলে সেখানের তরমুজ খেয়ে দেখতে পারেন।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণ প্যাকেজ
বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি সিজনের সময় সেন্টমার্টিন ভ্রমণ প্যাকেজ অফার করে। ভ্রমণ প্যাকেজ গুলো সাধারণত সেন্টমার্টিন ১ রাত বা ২ রাত থাকা, যাওয়া আসার খরচ, খাবার খরচ সহ সবকিছু অন্তর্ভুক্ত থাকে। সেন্টমার্টিন ভ্রমণ প্যাকেজ খরচ নির্ভর করে কোন মানের জাহাজে যাওয়া আসা হবে, কেমন মানের রিসোর্টে রাখবে এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার উপর। সাধারণত ট্যুর এজেন্সির প্যাকেজ প্রাইস গুলো ঢাকা থেকে যাওয়া আসা সহ জনপ্রতি ৫,৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
যাওয়া আসার বাস টিকেট, শীপ টিকেট কাটা ও সেখানের রিসোর্টে বুকিং করা অনেকের কাছে ঝামেলার মনে হতে পারে। যদি নিজেরা সবকিছুর আয়োজন করতে না চান, ঝামেলা কমাতে চান তাহলে ভালো দেখে কোন ট্যুর এজেন্সির মাধ্যমে সেন্টমার্টিন ট্যুর প্যাকেজে ভ্রমণ করতে পারেন।
ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
• সেন্টমার্টিন আমাদের দেশের সম্পদ, তাই প্রকৃতির ক্ষতি হয়ে এমন কিছু করবেন না।
• সেন্টমার্টিনে মোবাইল ফ্রিকোয়েন্সি কম থাকে। কথা বলতে সমস্যা হতে পারে। তবে টেলিটক তুলনামূলক ভাল কাজ করে।
• বর্তমানে নিয়মিতভাবে সেন্টমার্টিনে বিজিবি টহল দেয়। তারা অনেক সময় রাত ১২টার পর পর্যটকদেরকে বীচ বা জেটি এলাকায় থাকতে নিষেধ করে।
• সঠিক জায়গায় ময়লা আবর্জনা ফেলবেন। দয়া করে প্লাস্টিক/পলিথিন কিছু সৈকতে ফেলে আসবেন না।
• কম খরচে সেন্টমার্টিন থাকা ও খাওয়ার জন্যে ছুটির দিন গুলোতে না গিয়ে অন্যান্য দিনে যেতে পারেন।
• বর্তমানে সেন্টমার্টিনে অনেক হোটেল ও কটেজ গড়ে উঠেছে, থাকার জায়গায়র অভাব তেমন হয় না।
• পর্যটন এলাকায় যে কোন কিছুর জন্যে দরদাম করবেন কেনাকাটায়।
• মানুষ বেশি হলে আগেই শিপের টিকেট কেটে রাখতে পারেন।
• দালালদের খপ্পরে পড়বেন না। নিজেই সবকিছু করুন।
• চাইলে কক্সবাজার বিভিন্ন এজেন্ট থেকে সেন্টমার্টিন এর প্যাকেজ কিনে নিতে পারবেন।
• সেন্ট মার্টিন যাওয়া আসার সময় জাহাজের ডেক থেকেই সবচেয়ে সুন্দর ভিউ দেখতে পাবেন।
• সমুদ্রে নামার সময় সতর্ক থাকুন।