লোনাপানির বৃহত্তম কুমির 

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ—এই অসাধারণ বাগ্‌ধারাটি কী ভেবে কে রচনা করেছিলেন, সে প্রশ্ন প্রায়ই আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। আক্ষরিক অর্থে বাগ্‌ধারাটি সুন্দরবনের জন্য এতটাই জুতসই যে সুন্দরবনের অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই হয়তো এটি রচনা করা হয়েছিল! কারণ, সুন্দরবন ছাড়া আর কোনো জলার বনে যেমন বাঘ নেই, তেমনি সুন্দরবনের নদী-খাল ছাড়া আর কোথাও কুমিরও দেখা যায় না

গত ডিসেম্বরে গবেষণার কাজে সাতক্ষীরা সুন্দরবনের কয়লা-বেহালা খালে কুমির নিয়ে ঘটে এক মজার কাণ্ড। সময়টা প্রায় ভরদুপুর। কুয়াশা কেটে গিয়ে সূর্যের আলো ফুটেছে বেশ পরে, ফলে রোদের তেজ গায়ে লাগছে। সূর্য মাথায় নিয়ে আমরা পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছি। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আমাদের টিমের একজন চিৎকার করে উঠল কুমির, কুমির বলে। বিশালাকার একটি কুমির কাদাচরে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। স্বাভাবিকের চেয়ে কুমিরটি বেশ কালো, গায়ে রোদে শুকিয়ে যাওয়া কাদার সাদাটে দাগ। কাছাকাছি গিয়ে ছবি তোলার জন্য আমাদের জালিবোট কুমিরের দিকে চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে কুমিরের কাছাকাছি বোটটি একেবারে খালের পাড়ে গিয়ে ঠেকল। কিন্তু তারপরও কুমিরের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। কুমিরের চোখ বন্ধ, পাগুলো কাদার মধ্যে কিছুটা ঢোকানো। ফলে সবার মধ্যে একটা ধারণা হলো যে কুমিরটি হয়তো মারা গেছে। দলের কেউ কেউ কুমিরের ‘ময়নাতদন্ত’ করতে কাদায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কুমিরের চোখের পাতা একটু নড়ল যেন। তারপর মুহূর্তেই কুমিরটি তার বিশাল দেহ বাঁকিয়ে বিকট শব্দে একলাফে পানিতে গিয়ে পড়ল। আমরা একটি সম্ভাব্য বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম বলে মনে হলো।

সুন্দরবনের এই কুমিরের নাম লোনাপানির কুমির, ইংরেজিতে সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল। পৃথিবীতে যে তিন প্রকারের কুমির আছে, তার মধ্যে এই লোনাপানির কুমির সবচেয়ে বড়। এটি লম্বায় ২৩ ফুট, ওজনে ১ হাজার কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে এটি দেখা যায়। বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও লোনাপানির কুমির নেই। 

এশিয়া অঞ্চলে দেখা যায় দুই প্রজাতির কুমির। একটি লোনাপানির কুমির, অন্যটি মিঠাপানির কুমির। মিঠাপানির কুমির একসময় আমাদের দেশের নদ-নদীতে বেশ দেখা যেত। উত্তর-পূর্ব সুন্দরবনেও এটি বিচরণ করত। সত্তরের দশকে এটি দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এটি আকারে লোনাপানির কুমিরের চেয়ে কিছুটা ছোট। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় মিঠাপানির কুমির এখনো দেখা যায়।

কুমির শীতল রক্তবিশিষ্ট সরীসৃপ প্রাণী। এর অর্থ, পরিবেশের তাপমাত্রা কমে গেলে কুমিরের দেহের তাপমাত্রাও কমে যায়। আমাদের মতো কুমির নিজের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে শীতকালে তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে কুমির ভাটার সময় সুন্দরবনের কাদাচরে রোদ পোহায়। এতে দেহের তাপমাত্রা বাড়ে, ফলে দৈহিক কার্যক্রম চলমান থাকে। তাই শীতকালে প্রায়ই সুন্দরবনের কাদাচরে কুমির দেখা যায়।

সুন্দরবনের খালের পাড়ে রোদ পোহাচ্ছে লোনাপানির কুমির

সুন্দরবনের উঁচু এলাকায় গুল্ম, গাছের ডালপালা দিয়ে বাসা বানিয়ে ২০-৭২টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। প্রায় তিন মাস ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা তোলে। বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া—এসব স্ত্রী কুমির একাই করে। মা কুমির বেশ কিছুদিন বাচ্চাদের লালন-পালনও করে থাকে। 

২০১৮ সালের এই লেখকের একটি গবেষণামতে, সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা প্রায় দুই শচাঁদপাই ও শরণখোলা এলাকায় কুমির দেখা যায় বেশি। সত্তর-আশির দশকে সুন্দরবনে কুমির শিকার হতো দেদার, ফলে এদের সংখ্যা দ্রুত নেমে আসে। বর্তমানে ধীরে ধীরে কুমিরের সংখ্যা বাড়ছে বলে ধারণা করি। বাঘ যেমন সুন্দরবনের স্থলজ প্রতিবেশব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক, তেমনি কুমির জলজ প্রতিবেশব্যবস্থায় বড় ভূমিকা পালন করে। জলজ পরিবেশের রুগ্‌ণ ও রাক্ষুসে মাছ খেয়ে প্রতিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে এই কুমির। সুন্দরবনের এই কুমিরের একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা হওয়া জরুরি।

← New Article
বনবাস ইকো ভিলেজ – [Banabash Eco Village]

বনবাস ইকো ভিলেজ – [Banabash Eco Village]

Old Article →
সুন্দরী ইকো রিসোর্ট – [Sundori Eco Resort]

সুন্দরী ইকো রিসোর্ট – [Sundori Eco Resort]